দুনিয়ার স্রষ্টানির্ধারিত নিয়ম মেনে সূর্য প্রত্যেক দিন পূর্ব দিক থেকে ওঠে, পশ্চিম দিকে ডোবে। কখনোই এর ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু সূর্যরশ্মির ভূমিকা কি দুনিয়াকে আলোকিত করা, গাছপালা বেড়ে উঠতে সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আমার সাথে এমন একটা দুনিয়ার কথা কল্পনা করুন তো, যেখানে সূর্যরশ্মি কেবল উদয়-অস্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আপনার দেহের এনার্জি, মনের ভালো-লাগা কিংবা খারাপ-লাগা এবং সামগ্রিকভাবে বললে আপনার লাইফস্টাইলের ওপর সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব রাখে? বিষয়টা মজার হতো তাই না? তার চেয়েও মজার বিষয় কি জানেন? আপনি যে দুনিয়ায় বাস করছেন সেখানে সূর্যরশ্মি এই সবগুলো বিষয়ই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর যে প্রক্রিয়ায় এটা ঘটে সেটাই হলো সার্কেডিয়ান রিদম। সার্কেডিয়ান রিদম হলো দেহের নানা জৈবিক কার্যকলাপের প্রক্রিয়া যা আপনার ঘুমের ধরণ থেকে শুরু করে হরমোনের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করে। সূর্যের আলো যখন রঙ্গিন আলোর ছটায় আকাশকে ভোর থেকে শুরু করে বিকেলের পড়ন্ত বেলাকে আলোকিত করে, তখন আপনার দেহও সূর্যরশ্মির ছন্দের তালে নেচে নেচে ওঠে।
সারাটা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর আপনি আরামের ঘুম ঘুমোতে গেলেন। আর আপনার দেহও প্রস্তুত হয়ে গেলো এক বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য। তাকে তো সারাদিনের ধকলকে পুষিয়ে তুলতে হবে, আবার চাঙ্গা করে তুলতে হবে দেহের প্রতিটি কোষ। ব্রেইনকে প্রস্তুত করতে হবে পরের দিনের কাজের জন্য। রাত গড়িয়ে ভোর হলো। বিছানার পাশের জানালা দিয়ে আপনাকে চুমু খেয়ে গেলো ভোরের মৃদু সূর্যালোক। আপনার দেহের ভেতরের স্প্রিংগুলো যেন তড়াক করে লাফ মেরে উঠলো। সূর্যের আলো যেন এক এলার্ম ক্লক, মৃদু চুমু দিয়ে জানিয়ে দিল – উঠে পড়ো, প্রস্তুতি নাও নতুন দিনের। এই যে অসাধারণ এক ঘটনা ঘটল এটা আসলে কি? কেন আমাদের অস্তিত্বের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী? এই লেখায় আপনাকে নিয়ে যাব সার্কেডিয়ান রিদমের এক আলোময় ভ্রমণে, যেখানে বিজ্ঞান মিলিত হয় শিল্পের সাথে, আর আপনার দেহ আন্দোলিত হয় শিল্পের তালে।
সার্কেডিয়ান রিদম হলো দেহের নানা জৈবিক কার্যকলাপের প্রক্রিয়া যা আপনার ঘুমের ধরণ থেকে শুরু করে হরমোনের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করে। সূর্যের আলো যখন রঙ্গিন আলোর ছটায় আকাশকে ভোর থেকে শুরু করে বিকেলের পড়ন্ত বেলাকে আলোকিত করে, তখন আপনার দেহও সূর্যরশ্মির ছন্দের তালে নেচে নেচে ওঠে।
সহজ ভাষায় বললে, দেহের ভেতরে যে ঘড়িটা আছে সেটাই সার্কেডিয়ান রিদম। আমাদের দেহের স্বাভাবিক চক্রগুলো দেখাশোনা করে এটি। “Circa” একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ চারপাশ এবং “diem” শব্দের অর্থ দিন। সার্কেডিয়ান রিদমের ছন্দগুলো দেহে নানা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া পরিচালিত করে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি থেকে শুরু করে হরমোনের নিঃসরণ, আপনার অস্তিত্বের প্রতিটা অংশ যেন এই অভ্যন্তরীন ছন্দের প্রভাবে চলছে মহান আল্লাহর সুনিপুণ নির্দেশে।
সার্কেডিয়ান রিদমের একদম কেন্দ্রে, অর্থাৎ যেখান থেকে এই রিদমটি পরিচালিত হয় তা হলো সুপ্রাকিয়াসম্যাটিক নিউক্লিয়াস (SupraChiasmatic Nucleus – SCN)। এটা হচ্ছে এক গুচ্ছ কোষ যা ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস অংশে থাকে। একে “মাস্টার ক্লক”-ও বলা হয়। বিভিন্ন বাহ্যিক উৎস থেকে এসসিএন নানা উদ্দীপনা গ্রহণ করে। তবে সাধারণত পরিবেশে আলোর তীব্রতা মাপাই এর কাজ। কখন সূর্যালোক উঠছে, কখন আলো কমে যাচ্ছে তা মনিটর করে এসসিএন। যেন সেগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেহের জৈবিক ঘড়ি কে ম্যানেজ করা যায়। আর দেহের জৈবিক ঘড়ি পরিবেশের আলোর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করে কখন আপনি জাগবেন, কখন ক্ষুধা লাগবে আপনার, কখন ঘুম ঘুম ভাব আসবে চোখে।
সার্কেডিয়ান রিদমের ম্যাজিক হচ্ছে, দূর আকাশে সূর্যের পরিভ্রমণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এটা। চোখের রেটিনা পরিবেশে আলোর বাড়া-কমা মনিটর করে, তারপর সেটার সিগন্যাল পাঠায় এসসিএনে। সিগন্যাল পেয়ে এসসিএন নির্দিষ্ট হরমোন নিঃসরণ করে। আলো ও রাসায়নিক পদার্থের এই জটিল খেলা – যেমন, মেলাটোনিন হরমোন ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে – আমাদের দেহকে কখনো ঘুম পাড়ায় কখনো জাগিয়ে দেয়।
কিন্তু সার্কেডিয়ান রিদম শুধু ঘুম ও ঘুমের ধরণকেই নিয়ন্ত্রণ করে না; বরঞ্চ এটা আপনার জীবনের প্রায় প্রতিটা দিককে প্রভাবিত করে। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ, মনোযোগ, হজম, শারীরিক তাপমাত্রা এবং এমনকি কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও এই দৈহিক ছন্দের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত।
কিন্তু বর্তমানে সার্কেডিয়ান রিদম তার কাজ ঠিকমতো করতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃত্রিম বাতির আলো, রাতের বেলা কাজ করা, দিনরাত ডিভাইসের সামনে পড়ে থাকার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ছন্দপতন ঘটছে। আগে সূর্য ডুবে গেলেই সার্কেডিয়ান রিদম বুঝে যেত ঘুমানোর সময় হয়েছে। কিন্তু কৃত্রিম আলোর তীব্র ছটার কারণে গভীর রাতেও সার্কেডিয়ান রিদম কনফিউজ হয়ে বসে থাকছে, কারণ এখনো সে দিনের আলোর মতোই আলো পাচ্ছে। ফলে তার বোঝার উপায় নেই, রাত হয়েছে কী না। ছন্দপতনের কারণে আমরা নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না, স্থূলতা বাড়ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছি, মন খারাপ থাকছে। আধুনিক জীবনের চাহিদা যখন আমাদের জৈবিক ঘড়ির সাথে মিলে যাবে, তখনই আমরা সুন্দর জীবনযাপন করতে পারব।
GIPHY App Key not set. Please check settings