যেভাবে রিসেট করবেন আপনার সার্কেডিয়ান রিদম
সার্কেডিয়ান রিদম হল আপনার দেহের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি বা দেহঘড়ি। একে জৈবিক ঘড়িও বলা হয়। এটি ২৪ ঘন্টাব্যাপী চক্রে দেহের নানা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সার্কেডিয়ান রিদম ঠিক থাকলে এটি সঠিক ঘুম, সঠিক মাত্রায় হরমোন উৎপাদন, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আধুনিক জীবনযাপন সার্কেডিয়ান রিদমের ওপর যেন কুঠার দিয়ে আঘাত হেনেছে। আধুনিক জীবনযাপনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে ঘুমের বারোটা বাজিয়েছি। আমরা সঠিক সময়ে ঘুমোতে যাই না। প্রচুর পরিমাণে সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ব্যয় করি। আমাদের কাজের সময়ও বদলে গেছে। আগে দিনে কাজ করা হতো, রাতে ঘুমানো হতো। এখন ফ্রিল্যান্সার, সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভারসহ অনেকেই রাতের বেলা ডিউটি করেন। তবে সুখবর হচ্ছে, আপনার নিত্যদিনের রুটিনে সামান্য পরিবর্তন এনেই সার্কেডিয়ান রিদম রিসেট করতে পারবেন। কীভাবে বিভিন্ন টেকনিক প্রয়োগ করে আপনার দেহঘড়িকে রিসেট করতে পারবেন সেটাই আলোচনা করব।
সার্কেডিয়ান রিদম কি?
সার্কেডিয়ান রিদম কি তা আগের ৩টি লেখায় উল্লেখ করেছি। লেখাগুলো নিচের লিংক থেকে পড়তে পারবেন। সার্কেডিয়ান রিদম মূলত আলো ও অন্ধকারের উপস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস অংশের একটি ক্ষুদ্র স্থানের নাম হলো সুপ্রাকিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াস বা SCN। এটি মাস্টার ক্লক হিসেবে কাজ করে। চোখে যে আলোর সিগন্যাল এসে পড়ে এটি সেটার প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। যখন দিনের বেলা উজ্জ্বল আলোর সংস্পর্শে যাওয়া হয় তখন SCN সিগন্যাল পাঠায় যে মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদন কমিয়ে দিতে হবে। মেলাটোনিন হরমোন ঘুম ঘুম ভাব সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই হরমোনের উৎপাদন কমে যাওয়া মানে আপনার ব্রেইনও থাকবে জাগ্রত। বিকেলে যখন চারিদিক ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে যেতে শুরু করে, মেলাটোনিনের উৎপাদন বেড়ে যায়। তখন আপনি এক ধরণের রিল্যাক্স মোডে চলে যেতে থাকেন, আপনার ঘুম ঘুম লাগা শুরু হয়।
→ জৈবিক ঘড়ি সার্কেডিয়ান রিদম কী, লাইফস্টাইলে এর প্রভাব
→ নামাজ-রোজা যেভাবে দেহঘড়ি (সার্কেডিয়ান রিদম) নিয়ন্ত্রণ করে
→ সার্কেডিয়ান রিদম যেভাবে বদলে দিতে পারে আপনার জীবন
১. আলোর সংস্পর্শে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন
ক. প্রভাতের আলো
আপনার দিন শুরু করুন প্রভাতের আলো গায়ে মেখে। জানালার পর্দা সরিয়ে দিন। ঘুম থেকে ওঠার পরপরই বাইরে যেয়ে ২০-৩০ মিনিট হেঁটে আসুন। হাঁটতে মন না চাইলে অন্তত গায়ে রোদটা লাগান। এটা আপনার দেহকে সিগন্যাল দিবে যে, সকাল হয়েছে। এখন আর ঘুমোনো যাবে না। জাগ্রত থাকতে হবে সদা।
খ. দিনের আলোর সংস্পর্শ
সারাদিন জুড়ে আলোকিত পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন। সেটা ঘরের বাইরে বা ভেতরে যেখানেই হোক। ঘরের ভেতর জানালার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন। বিকেল বেলা কৃত্রিম বাতির উপস্থিতিতে থাকা কমিয়ে দিন। বিশেষ করে ইলেকট্রোনিক ডিভাইসগুলো থেকে যে ব্লু লাইট বের হয় তা বেশ ক্ষতিকর। কারণ এটা মেলাটোনিন উৎপাদন দমিয়ে দিতে পারে।
গ. সন্ধ্যার আবছাতা
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আপনার শরীরকে রিল্যাক্স মোডে যাওয়ার সংকেত দেওয়ার জন্য একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করুন। আলোর উজ্জ্বলতা কমিয়ে দিন, ফোন বা ল্যাপটপের ব্রাইটনেস কমিয়ে রাখুন। রাতে ভারী কাজ করবেন না।
২. সঠিক সময়ে ঘুমান
ক. ঘুমানোর সময় ও জেগে ওঠার সময় নির্দিষ্ট রাখুন
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার এবং জাগ্রত হওয়ার সময় নির্ধারিত রাখুন। চেষ্টা করবেন এর ব্যতিক্রম যেন না ঘটে। নিয়মিত একই সময়ে ঘুমোতে যাওয়ার দ্বারা আপনার অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, এটা একটা রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। আপনার পক্ষেও দৈনিক একই সময়ে ঘুমোতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা সহজ হবে।
খ. দিনের বেলা লম্বা ঘুম ঘুমাবেন না
সম্ভব হলে দিনের বেলা লম্বা ঘুম পরিহার করুন। তবে দুপুর বেলা শরীরটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করে, ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব লাগে। এই ভাব কাটানোর জন্য, পুনরায় দেহটাকে এনার্জেটিক করার জন্য ভাতঘুম দিতে পারেন অল্প সময়ের জন্য। এই ধরুন ২০-৩০ মিনিট। দিনের বেলা লম্বা ঘুম ঘুমোলে রাতে ঘুম আসতে চাইবে না।
৩. ঘুমের জন্য দেহকে প্রস্তুত করুন
ক. ঘুমের উপযোগী পরিবেশ তৈরী করুন
আপনার ঘুমের পরিবেশটাকে আরামদায়ক করুন, বিশ্রামের উপযোগী করুন। নিশ্চিত করুন আপনার বেডরুমটা যেন অন্ধকার, নীরব হয়, ঘরে আরামদায়ক তাপমাত্রা বিরাজ করে।
খ. ক্যাফেইন ও চা-এর পরিমাণ মেপে চলুন
ঘুমের আগ দিয়ে চা বা কফি খাবেন না। এই জিনিসগুলো আপনার ঘুমের কোয়ালিটির চোদ্দটা বাজাবে। ঘুম আসতেও দেরি হবে।
৪. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন
ক. দৈনিক ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়ামে ব্যস্ত থাকুন। তবে ঘুমানোর অন্তত কয়েক ঘণ্টা আগে আপনার ওয়ার্কআউট শেষ করার চেষ্টা করবেন। শারীরিক ব্যায়াম আপনার স্লিপ সাইকেল নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করতে পারে।
খ. ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খান
দৈনিক ভারসাম্যপূর্ণ খাবার গ্রহণ করুন। সেখানে যেন প্রায় সব ধরণের পুষ্টি থাকে। ঘুমানোর সময় বা কাছাকাছি সময় ভারী তৈলাক্ত ও মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন। এতে পেটে যেমন অস্বস্তি তৈরী হবে, তেমনি ঘুমও ব্যাহত হবে।
৫. রিল্যাক্সিং ও ঘুমের পরিবেশ তৈরী করুন
ক. রিল্যাক্সের কৌশল
ঘুমের আগে ভারী কাজ না করে শান্ত বা ধীরস্থির পরিবেশের কাজগুলো করুন। যেমন, বই পড়ুন, হালকা ব্যায়াম করুন, জোরে শ্বাস নিন, নফল সালাত আদায় করুন।
খ. ডিজিটাল ডিটক্স
ঘুমানোর কয়েক ঘন্টা আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো শাটডাউন দিয়ে দিন। স্ক্রিন থেকে যেসব ব্লু-লাইট বের হয় সেগুলো মেলাটোনিন উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সার্কেডিয়ান রিদমকে ঠিকঠাক করা সহজ কাজ নয় বটে, আবার একদিনেও রিসেট করা যাবে না। এ জন্য দরকার ধারাবাহিকতা ও ডেডিকেশন। আলোর উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত একই সময়ে ঘুমোতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা, সুন্দরমতো ঘুমানো ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি দেহঘড়িকে ঠিকঠাক করে ফেলতে পারেন। মনে রাখবেন, সার্কেডিয়ান রিদমে ব্যালেন্স আনতে গেলে আপনার দৈনন্দিন জীবনের চাহিদার সাথে দেহঘড়ির সমন্বয় ঘটাতে হবে। ঘুমকে গুরত্ব দিন। এর সুফল আপনি অবশ্যই লাভ করবেন।
GIPHY App Key not set. Please check settings