আমার সাথে এমন একটা দুনিয়ার কথা কল্পনা করুন তো, যেখানে সূর্যরশ্মি কেবল উদয়-অস্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আপনার দেহের এনার্জি, মনের ভালো-লাগা কিংবা খারাপ-লাগা এবং সামগ্রিকভাবে বললে আপনার লাইফস্টাইলের ওপর সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব রাখে? বিষয়টা মজার হতো তাই না? তার চেয়েও মজার বিষয় কি জানেন? আপনি যে দুনিয়ায় বাস করছেন সেখানে সূর্যরশ্মি এই সবগুলো বিষয়ই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর যে প্রক্রিয়ায় এটা ঘটে সেটাই হলো সার্কেডিয়ান রিদম। এটা হলো আপনার এক গোপন অস্ত্র যা আপনার প্রোডাক্টিভিটির ওপর প্রভাব ফেলে, দেহের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে। সার্কেডিয়ান রিদম দেহের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি, যা আপনার জীবনে ছন্দ আনে। আমরা দেখব, একজনের জীবনে সার্কেডিয়ান রিদমের প্রভাব কেমন হতে পারে, দৈনন্দিনের রুটিনে এটা কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে এবং আপনার দীর্ঘমেয়াদী সুস্বাস্থ্যকে এটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।।
সার্কেডিয়ান রিদম কি?
আমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রে রয়েছে এক নিখুঁত সিস্টেম যা আমাদের ঘুমানো ও ঘুম থেকে জেগে ওঠাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি হরমোন উৎপাদন, বিপাক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজেও এটি ভূমিকা রাখে। এই সিস্টেমটির নাম হলো সার্কেডিয়ান রিদম। এটি এক জৈবিক প্রক্রিয়া যা প্রতি ২৪ ঘন্টা পর পর পুনরাবৃত্তি হয়। এই অভ্যন্তরীণ ঘড়িটি নির্ভর করে দিনের আলো ও রাতের অন্ধকার থেকে পাওয়া সিগন্যালের ওপর। এর ওপর ভিত্তি করেই দেহের কাজকর্মগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়।
সার্কেডিয়ান রিদম সম্পর্কে আমার ধারাবাহিক আলোচনার পূর্বের ২টি লেখা পড়তে নিচের লিংক ভিজিট করুন।
→ জৈবিক ঘড়ি সার্কেডিয়ান রিদম কী, লাইফস্টাইলে এর প্রভাব
→ নামাজ-রোজা যেভাবে দেহঘড়ি (সার্কেডিয়ান রিদম) নিয়ন্ত্রণ করে
দেহের ওপর সার্কেডিয়ান রিদমের উপকারিতা
১. ঘুম হয় ঠিকঠাক
কখন আপনাকে চোখ ছানাবড়া করে জাগিয়ে রাখতে হবে আর কখন আপনার ভেতর তৈরী করতে হবে ঘুমের আবেশ তা নির্ধারণে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আপনার সার্কেডিয়ান রিদম। আপনি যখন আপনার কাজকর্মগুলোকে সার্কেডিয়ান রিদমের সাথে সমন্বয় করে চলতে পারবেন, তখন আপনার ঘুমের গুণগত মানও বৃদ্ধি পাবে। আপনি প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে গেলে ও ঘুম থেকে উঠলে আপনার অভ্যন্তরীণ দেহঘড়িও ঠিকঠাক থাকবে। আপনার ঘুম থেকে ওঠার পর ম্যাজম্যাজে লাগবে না, দিনের বেলা সচেতন ও অ্যালার্ট থাকতে পারবেন। ঘুমজাতীয় সমস্যা জীবন থেকে বিদায় নেবে।
২. মনমেজাজ থাকবে ভালো
সার্কেডিয়ান রিদম আর মনমেজাজের সম্পর্ক পিঠেপিঠি ভাইবোনের মতো। সার্কেডিয়ান রিদমে ঝামেলা বাধলে, এটা উলটপালট হয়ে গেলে আপনার ভেতর মুড সুইং, মেজাজে খিটখিটে ভাব তৈরী হবে। এমনকি আরো বড় ও মারাত্মক অবস্থা যেমন ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির ফাঁদেও পড়ে যেতে পারেন। সার্কেডিয়ান রিদম মেনে চললে আপনার দেহে সঠিক মাত্রায় সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ ঘটবে। সারাদিনের চাপ ম্যানেজ করা ও বাইরে একটা ইতিবাচক ভাব জিয়ে রাখতে সেরোটোনিনের বেশ ভূমিকা আছে।
৩. বাড়বে প্রোডাক্টিভিটি
আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন দিনের কোনো কোনো সময়ে আপনি অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশী প্রোডাক্টিভ থাকেন? জ্বি, ওই সময় আপনার সার্কেডিয়ান রিদম তুঙ্গে থাকে। নির্দিষ্ট কিছু সময়ে আপনার ব্রেইনের কর্মক্ষমতা ও মনোযোগ প্রদানের ক্ষমতা তুঙ্গে থাকে। ফলে আপনিও জটিল কাজগুলো মনোযোগ লাগিয়ে করতে পারেন। যখন আপনি বুঝে যাবেন কখন আপনি খুব ভালো কাজ করতে পারেন, সে অনুযায়ী নিজের মানসিক শক্তিকে আরো দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারবেন।
৪. সুষম হরমোন নিয়ন্ত্রণ
সার্কেডিয়ান রিদম কর্টিসল, মেলাটোনিন এবং গ্রোথ হরমোন সহ বিভিন্ন হরমোনের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। কর্টিসল “স্ট্রেস হরমোন” হিসাবে পরিচিত। এটি সারা দিন ধরে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করে। সকালে কর্টিসলের মাত্রা বাড়ে, রাতের বেলা কমে। আপনি এই ছন্দের বিষয়টা মাথায় রাখলে ভালোমতো স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বা চাপ সামলাতে পারবেন। দেহের হরমোনের ভারসাম্য থাকবে ঠিকঠাক।
৫. দীর্ঘমেয়াদী সুস্বাস্থ্য রক্ষা
সার্কেডিয়ান রিদম মেনে চললে দীর্ঘমেয়াদে আপনার শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেহের ভেতরকার ঘড়ি ঠিকমতো পরিচালনা করলে আপনার নানা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। এর মধ্যে আছে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং নির্দিষ্ট কিছু ধরণের ক্যান্সার। প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ, ইমিউনের প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য নানা প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে এটি ভূমিকা রাখে।
৬. বিপাক প্রক্রিয়া
আপনার ডাইজেস্টিভ সিস্টেম বা পাচনতন্ত্র সার্কেডিয়ান রিদম মেনে চলে। আপনি নিজের দেহঘড়ির সাথে সমন্বয় করে খাবার খেলে সেটা আপনার বিপাক ও হজমশক্তি বাড়াতে পারে। ঠিকমতো পুষ্টির শোষণ ও ওয়েট ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো করার জন্য যখন দৈনন্দিনের কাজ করবেন তখন বেশী বেশী খাবার খাবেন এবং দিন যত গড়াবে খাবার গ্রহণের পরিমাণ তত কমিয়ে দিতে হবে।
GIPHY App Key not set. Please check settings