মদ বা অ্যালকোহল পান করা যে কতটা ক্ষতিকর তা কিন্তু আমরা সবাই জানি। নিয়মিত অ্যালকোহল পান লিভারের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। অ্যালকোহল বিষাক্ত হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। এর মূল কারণটা হচ্ছে, অ্যালকোহল পানের সাথে সাথেই দেহের ওপর অ্যালকোহলের প্রভাব পড়ে। কয়েক চুমুক খেলেই মাতাল ভাব চলে আসে। হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, রক্তের নালীগুলো প্রসারিত হয়ে যায়, দেহে ঝিমুনি চলে আসে। মনে হয় কেউ যেন দেহে “বিষ” প্রয়োগ করেছে। তাই মদ ক্ষতিকর হওয়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই।
কোনো বাবা-মা কি কখনো তার সন্তানদের অ্যালকোহল পান করাবেন? নিশ্চয়ই না। কিন্তু অ্যালকোহল বা তার চেয়েও ক্ষতিকর একটি জিনিসের নাম আপনাকে বলতে চাই যা আমরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের নিয়মিত খাওয়াচ্ছি, নিজেরাও খাচ্ছি। যেটা খেলে আমাদের মদ্যপ মনে হয় না, তাৎক্ষণিক প্রভাবও পড়ে না। আর সেটা হলো চিনি। জ্বি ঠিকই পড়েছেন, চিনি। কিন্তু কেন চিনি এত ক্ষতিকর? আসুন, সেটাই আলোচনা করব আমরা।
চিনি কেন এত ক্ষতিকর?
চিনিতে এক অণু সুক্রোজ আর এক অণু ফ্রুক্টোজ থাকে। সমস্যাটি লুকিয়ে আছে আমাদের দেহ কীভাবে ফ্রুক্টোজকে সংশ্লেষ করে তার ভেতর। চিনি এবং অ্যালকোহল উভয়ই প্রায় একইরকমভাবে দেহে সংশ্লেষিত হয়।
লিভারে প্রদাহর জন্য দায়ি চিনি
চিনি এবং অ্যালকোহলের সংশ্লেষণের অধিকাংশটাই ঘটে লিভারে। লিভার অ্যালকোহলকে অ্যাসিটালডিহাইড ও অ্যাসিটেটে রূপান্তর করে। যার ফলে লিভারের বারোটা বেজে যায়, অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। তেমনি, যখন বেশী পরিমাণে ফ্রুক্টোজ বা চিনি খাওয়া হয়, তখন লিভারের সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার ওপর প্রচুর চাপ পড়ে। ফ্রুক্টোজ গ্লুকোজে রুপান্তর হওয়ার বদলে হয়ে যায় ফ্যাট। এর ফলে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া ইনসুলিন রেজিসট্যান্স, মেটাবলিক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। [১]
প্রচুর পরিমাণে চিনি খাওয়ার ফলে অ্যালকোহলের মতো লিভারে প্রদাহ ও সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফ্রুক্টোজ খাওয়ার কারণে লাইপোজেনেসিস অর্থাৎ লিভারে ফ্যাট উৎপন্ন হয়। এতে লিভারে ট্রাইগ্লিসারাইড জমা হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার কারণে হেপাটিক প্রদাহ হয়। বিষয়টা অ্যালকোহল পানেও ঘটে থাকে। [২]
ব্রেইনেও কি ক্ষতিকর প্রভাব পরে?
এতক্ষণ শুধু লিভারের ওপর প্রভাব নিয়ে কথা বললাম। ব্রেইনে কি ঘটে সেটা এবার দেখা যাক। অ্যালকোহল পানের কারণে ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যকলাপে সমস্যা দেখা দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা কমে যায়, আসক্তি সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে চিনিও অনেকটা একইরকম প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কে। চিনি খাওয়ার পর মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক একটি নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ ঘটে। ডোপামিন নিঃসরণ হলে আনন্দ বা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরী হয়। ডোপামিন নিঃসরণের কারণে ব্যক্তি বারবার ঐ আনন্দ, ঐ মজাটা পেতে চায়। ফলে চিনিজাতীয় খাবারে তার আসক্তি তৈরী হয়। চিনি খাওয়া বেড়ে যায়। ঠিক অ্যালকোহলের মতো। [৩]
পাকস্থলীতে চিনির ক্ষতিকর প্রভাব
চিনি খাওয়ার কারণে পাকস্থলীর নানাবিধ সমস্যা তৈরী হয়। খাদ্য সংশ্লেষণেও সমস্যার সৃষ্টি করে এটি। এর ফলে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ইনসুলিন রেজিসট্যান্স, অস্বাভাবিক চর্বির মাত্রাসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা যায়। এ ছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। চিনি, বিশেষ করে ফ্রুক্টোজ গ্রহণ হাইপারটেনশন, প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরীতে ভূমিকা রাখে। আর এই জিনিসগুলো হৃদরোগ হবার পূর্বের লক্ষণ। [৪]
চিনির আসক্তি আমাদের কার নেই? প্রায় সবাই আমরা প্রচুর পরিমাণে চিনি খাই। মিষ্টিজাতীয় খাবারে চিনি তো অপরিহার্য উপাদান। প্রতিটা প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবারে, সফট ড্রিংকসে, মিষ্টিতে, সেমাইয়ে, পুডিংয়ে সব জায়গায় চিনি। [৫] চিনির দাম বাজারে আগুন হওয়ার পরও আমরা চিনির ব্যবহার কতটা কমাতে পেরেছি? অথচ এই চিনি আমাদের আয়ুকে দিন দিন নিঃশেষ করে দিচ্ছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের মৃত্যুঝুঁকি। তাই এখনই আমাদের সময় সচেতন হওয়ার। মাঝে মধ্যে চিনি খেলে হয়তো তেমন বিপদে পড়তে হবে না। তাই আমাদেরকে অবশ্যই চিনি খাওয়া হয় সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে নয়তো খাওয়ার পরিমাণ অন্তত কমিয়ে দিতে হবে যেন নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে আমরা নিজেদের হিফাজত করতে পারি। চিনির ক্ষতিকর প্রভাব হয়তো আজ দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ, এর প্রভাব অ্যালকোহলের মতো সাথে সাথে পড়ে না বরং কিছুটা সময় লাগে। তবে এর যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। চিনির ক্ষতিকর দিক এড়িয়ে যাবার কোনো রাস্তা আমাদের সামনে খোলা নেই। [৬]
আমি এখানে অ্যালকোহলের সাথে চিনির একটা তুলনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে চিনি কতটা ক্ষতিকর। কারণ, অ্যালকোহলকে ক্ষতিকর মানলেও চিনির ব্যাপারে আমাদের আছে বেজায় আপত্তি। আমরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারি তাহলে চিনির অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে অবশ্যই আমরা সচেতন হতে পারব ইনশাআল্লাহ। আর সুন্দর সুস্বাস্থ্যময় জীবন গড়ে তুলতে পারব।
তথ্যসূত্রঃ
[১] Oliveira, D. T., Chaves-Filho, A. B., Yoshinaga, M. Y., Paiva, N. C. N., Carneiro, C. M., Miyamoto, S., … & Guerra-Sá, R. (2021). Liver lipidome signature and metabolic pathways in nonalcoholic fatty liver disease induced by a high-sugar diet. The Journal of Nutritional Biochemistry, 87, 108519.
[২] Muriel, P., López-Sánchez, P., & Ramos-Tovar, E. (2021). Fructose and the Liver. International journal of molecular sciences, 22(13), 6969.
[৩] Jamar, G., Ribeiro, D. A., & Pisani, L. P. (2021). High-fat or high-sugar diets as trigger inflammation in the microbiota-gut-brain axis. Critical reviews in food science and nutrition, 61(5), 836-854.
[৪] Johnson, Richard J., Mark S. Segal, Yuri Sautin, Takahiko Nakagawa, Daniel I. Feig, Duk-Hee Kang, Michael S. Gersch, Steven Benner, and Laura G. Sánchez-Lozada. “Potential role of sugar (fructose) in the epidemic of hypertension, obesity and the metabolic syndrome, diabetes, kidney disease, and cardiovascular disease.” The American journal of clinical nutrition 86, no. 4 (2007): 899-906.
[৫] Azaïs-Braesco, Véronique, Diewertje Sluik, Matthieu Maillot, Frans Kok, and Luis A. Moreno. “A review of total & added sugar intakes and dietary sources in Europe.” Nutrition journal 16, no. 1 (2017): 1-15.
[৬] World Health Organization. (2015). Guideline: sugars intake for adults and children. World Health Organization.
GIPHY App Key not set. Please check settings