টেস্টোস্টেরন বা টেস্টোস্টেরন হরমোনের কথা শুনলে কোন জিনিসটা আপনার মাথায় আসে? বীর্যবান পুরুষ? আক্রমণাত্মক, অধৈর্য, দৃঢ় আচরণ? সহিংসতা? টেস্টোস্টেরন মানেই বাজে আচার-আচরণ নয়। আমরা এই লেখায় জানব টেস্টোস্টেরন কি এবং দেহে এর ভূমিকা সম্পর্কে।
টেস্টোস্টেরন কি?
টেস্টোস্টেরন একটি যৌন হরমোন। ডাকপিয়ন যেরকম চিঠি বহন করে, তেমনি আমাদের দেহের রসায়ন পরিবহন করে এই হরমোন। তারা দেহের এক অঙ্গ থেকে আরেক অঙ্গে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করে। পুরুষের গঠন ও পুরুষালি বৈশিষ্ট্য প্রকাশে এর ভূমিকা অপরিহার্য।
ব্রেইনের ঠিক ভিত্তিতে রয়েছে পিটুইটারি গ্রন্থি। ব্রেইন থেকে পিটুইটারিতে পাঠানো সিগন্যাল পুরুষের টেস্টোস্টেরন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর পিটুইটারি গ্ল্যান্ড সিগন্যালটা পাঠিয়ে দেয় টেসটিসে, আর সেখানেই টেস্টোস্টেরন উৎপাদিত হয়। রক্তে হরমোনটির পরিমাণ কতখানি হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে একটি “ফিডব্যাক লুপ” বা “প্রতিক্রিয়া চক্র”। টেস্টোস্টেরনের মাত্রা খুব বেড়ে গেলে ব্রেইন পিটুইটারিতে সিগন্যাল পাঠায় উৎপাদন কমানোর জন্য।
টেস্টোস্টেরন কি কি কাজ করে?
টেস্টোস্টেরন শরীরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন:
- লিঙ্গ ও অণ্ডকোষের বিকাশ;
- বয়ঃসন্ধির সময় কণ্ঠস্বর গভীর হওয়া;
- বয়ঃসন্ধির শুরুতে মুখে দাড়ি এবং গুপ্তাঙ্গে লোমের আবির্ভাব; পরবর্তী জীবনে অবশ্য হরমোনটি আবার উল্টা কাজ করে মানে চুল পরা বা টাক পরার ক্ষেত্রে দায়ী থাকে;
- পেশীর আকার ও শক্তিবৃদ্ধি;
- হাড়ের বিকাশ ও শক্তিবৃদ্ধি;
- যৌনকামনা;
- শুক্রাণু উৎপাদন।

বয়ঃসন্ধিকালে যেসব ছেলেদের টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ কম থাকে তারা যথাযথ পুরুষালি হয়ে বড় না-ও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের যৌনাঙ্গ বড় হবে না, মুখ এবং শরীরে লোম কম হবে, গলার স্বর ডিপ হবে না।
টেস্টোস্টেরন স্বাভাবিক মেজাজ বজায় রাখতেও সাহায্য করে। এই হরমোনটির অনাবিষ্কৃত আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকতে পারে।
টেস্টোস্টেরন একটি যৌন হরমোন। ডাকপিয়ন যেরকম চিঠি বহন করে, তেমনি আমাদের দেহের রসায়ন পরিবহন করে এই হরমোন। তারা দেহের এক অঙ্গ থেকে আরেক অঙ্গে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করে। পুরুষের গঠন ও পুরুষালি বৈশিষ্ট্য প্রকাশে এর ভূমিকা অপরিহার্য।
টেস্টোস্টেরন এবং নারী
আপনি যদি ভেবে থাকেন টেস্টোস্টেরন কেবল পুরুষদেরই থাকে তাহলে আপনি ভুল করছেন। টেস্টোস্টেরন ডিম্বাশয় এবং অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে উৎপাদিত হয়। এটি নারীদের মধ্যে থাকা বেশ কয়েকটি অ্যান্ড্রোজেনের (পুরুষ সেক্স হরমোন) মধ্যে একটি। ধারণা করা হয় নারীসুলভ বেশ কিছু কাজে এর প্রভাব আছে। যেমনঃ
- ডিম্বাশয়ের কাজ;
- হাড়ের শক্তিবৃদ্ধি;
- যৌন আচরণ এবং স্বাভাবিক যৌনকামনা।
ডিম্বাশয় স্বাভাবিকভাবে কাজ করার জন্য (অন্যান্য এন্ড্রোজেনের পাশাপাশি) টেস্টোস্টেরন এবং এস্ট্রোজেনের (নারী হরমোন) মধ্যে সঠিক ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, অ্যান্ড্রোজেনগুলো স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় (মেজাজ, যৌনকামনা, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ইত্যাদি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
টেস্টোস্টেরন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে কি হয়?
আমরা অস্বাভাবিক মাত্রার উচ্চ টেস্টোস্টেরন সাধারণত যাদের মধ্যে দেখি তারা হল বিভিন্ন অ্যাথলেট। এরা অ্যানাবলিক স্টেরয়েড, টেস্টোস্টেরন বা এ ধরণের হরমোন ব্যবহার করে পেশির ঘনত্ব এবং অ্যাথলেটিক পারফরমেন্স বাড়ানোর জন্য।
পুরুষদের মধ্যে যারা কৃত্রিমভাবে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি করে তাদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে যেমনঃ
- শুক্রাণুর সংখ্যা কম হওয়া, অণ্ডকোষ সঙ্কুচিত হওয়া এবং পুরুষত্বহীনতা; (বিষয়টা বিপরীত লাগছে না?) (অদ্ভুত মনে হচ্ছে, তাই না?)
- হৃৎপেশীর ক্ষতি হওয়া এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি;
- প্রস্রাব করতে অসুবিধা হয়;
- প্রোস্টেট বৃদ্ধি পায়;
- যকৃতের রোগ হয়;
- ব্রণ ওঠা;
- দেহ তরল ধারণ করে ফলে পা ও পায়ের পাতা ফুলে যায়;
- ওজন বৃদ্ধি পায় কারণ ক্ষুধাও বেড়ে যায়;
- উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল;
- অনিদ্রা;
- মাথাব্যথা;
- পেশীর ঘনত্ব বৃদ্ধি;
- রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেড়ে যায়;
- বয়ঃসন্ধিকালের গঠন হ্রাস পায়;
- আক্রমনাত্মক আচরণ দেখা দেয়;
- ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন, উচ্ছ্বাস, বিরক্তি, বিভ্রম ইত্যাদি দেখা যায়।
মহিলাদের মধ্যে হাই টেস্টোস্টেরনের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)। এই রোগটি নারীদের মধ্যে বেশ কমন। প্রিমেনোপজাল অবস্থায় নারীদের ৬ থেকে ১০ শতাংশ এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
পিসিওএস (PCOS) নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়ে অন্য একটি লেখা পড়তে নিচের লিংকটিতে ক্লিক করুন।
⇢ ৫টি খাবার যা প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রন করবে পিসিওএস এর উপসর্গ
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম – এ আক্রান্ত মহিলাদের ডিম্বাশয়ে একাধিক সিস্ট থাকে। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অনিয়মিত পিরিয়ড, উর্বরতা কমে যাওয়া, মুখের অতিরিক্ত বা ঘন লোমের উপস্থিতি। এছাড়া পুরুষদের মতো টাক, কালো ও পুরু ত্বক, ওজন বৃদ্ধি, বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ ইত্যাদি দেখা যায়।
রোগ বা মাদক গ্রহণের কারণেও কিছু নারীর টেস্টোস্টেরন লেভেল বেড়ে যায়। এতে তাদের স্তনের আকার ছোট হয়ে যেতে পারে, গলার স্বর গভীর হতে পারে। এ ছাড়া পুরুষদের যেসব সমস্যা হয় সেগুলোর কিছুও দেখা যেতে পারে।
শেষ কথা
টেস্টোস্টেরন নিয়ে অনেক কথাই প্রচলিত আছে সমাজে যার সবগুলো সঠিক নয়। নারী-পুরুষ উভয়েরই পর্যাপ্ত অর্থাৎ সঠিক পরিমাণে টেস্টোস্টেরন দরকার যেন তাদের গঠন ভালোমতো হয় এবং তারা সঠিকভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। তবে দেহে আসলে সঠিক টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কতটুকু এটা নিয়ে বিতর্ক আছে এবং আজও কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
টেস্টোস্টেরন লেভেল চেক করা রক্ত পরীক্ষা করার মতোই সহজ। তবে কঠিন কাজ হলো ফলাফলটা বের করা। টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ সারা দিনেই পরিবর্তিত হয়। দিনের একেক সময় একেক লেভেল থাকে। তাই সকালে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বের করাই সবচেয়ে ভালো হবে। বারবার টেস্ট করার পরেও অস্বাভাবিক রকমের কম টেস্টোস্টেরন লেভেল পাওয়া গেলে শুরুতেই টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেওয়া শুরু করা ঠিক হবে না। এ জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে, যথাযথ পরামর্শ নিতে হবে। কারণ অনেক সময় কোনো থেরাপি ছাড়াই কেবল লাইফস্টাইলের পরিবর্তনের দ্বারাও টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
GIPHY App Key not set. Please check settings