আমি আমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুসারে মানসিক চাপ ও দুঃখ মোকাবিলার পাঁচটি উপায় উল্লেখ করব।
প্রথম যে বিষয়টা বুঝতে হবে তা হল, মহান আল্লাহ আমাদের জীবনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রক। আমাদেরকে কদরের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে, আমাদের সাথে যা ঘটে তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে। যদি কোনো কিছু না ঘটা কদরে লেখা থাকে, তাহলে সেটা কখনই ঘটবে না। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত গাছের একটা পাতাও পড়ে না। মানসিক চাপ ও দুঃখ মোকাবিলার সেরা অ্যান্টিডোটগুলোর মধ্যে এটা একটা।
যখন আপনি উদ্বিগ্নতায় ভোগেন, টেনশন আপনাকে ঘিরে ফেলে তখন অবশ্যই স্মরণে রাখবেন যে, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে আল্লাহ আছেন, আপনি নন। যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম গুহায় লুকিয়ে ছিলেন, তখন মুশরিকরা তাঁর খোঁজ করছিল লুকিয়া থাকা জায়গায়। আবু বকর রা. তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, ভয় পাবে না। আল্লাহ আমাদের সাথেই আছেন।
এক আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন
মানসিক চাপ ও দুঃখ মোকাবিলার সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিডোট হল, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। যখন ফিরআউনের বাহিনী মুসা আলাইহিস সালামের বাহিনীকে তাড়া করছিল, তখন এক পর্যায়ে তারা লোহিত সাগরের সামনে এসে পড়ে। আর তাদের পেছনে ফিরআউনের বাহিনী। তাদের জন্য কোনো বিকল্প ছিল না, যাওয়ার জায়গা ছিল না। হয় লোহিত সাগরে ঝাঁপ দিতে হবে, নয়তো ফিরআউনের বাহিনীর হাতে নিহত হতে হবে। মুসা আলায়হিস সালামের অনুসারীরা অর্থাৎ বনি ইসরাইল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, “আমাদের হত্যা করা হবে।” কিন্তু আল্লাহ মুসা আলায়হিস সালামকে বনি ইসরাইলকে বলতে বলেন, “না! এটা কখনই হবে না। আমার রব আমার সাথেই আছেন।”
এভাবেই মানসিক চাপ ও দুঃখ মোকাবিলা করতে হয়। এখনই মনে জোর নিয়ে বলুন, আমার শত্রুরা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। আমার শত্রুরা আমার উপর কোনো ক্ষমতা রাখে না। আমার প্রভু আল্লাহই আমার সাথে আছেন।
কেবলমাত্র রবের দিকে ফেরার দ্বারা এবং তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ নির্ভর করার দ্বারাই আপনি দুঃখ ও মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে পারবেন। যা ঘটছে তা কেবল আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশেই ঘটছে। আপনার ব্যাপারে আল্লাহর পরিকল্পনা আপনার নিজের পরিকল্পনার চেয়ে উত্তম।
কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে
মানসিক চাপ ও দুঃখ মোকাবিলার দ্বিতীয় পদ্ধতি হল, প্রতিটা কষ্টের মধ্যেই রহমত আছে। হারানোর কিছু নেই, আছে অর্জনের। সহিহ হাদিসে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, কোনো মুসলিমকে যখন ক্লান্তি বা অসুস্থতা আক্রান্ত করে অথবা অতীতের কোনো মন খারাপের বিষয় (যেমন, বাবা-মার মৃত্যু বা প্রিয়তমের কাছে কষ্ট পাওয়া) অথবা ভবিষ্যতের (যেমন, কীভাবে আমার বিশাল ঋণ শোধ করব ইত্যাদি) তবে এসবের প্রতিদানে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করবেন।
কেউই উদ্বিগ্ন হতে চায় না, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে চায় না। মানসিক চাপ বা বিষণ্নতায় ভুগতে চায় না। কিন্তু যখন আমরা জীবনের বাস্তবতা অনুসারে এসবে আক্রান্ত হয়ে পড়ব, তখন মুসলিম হিসেবে নিজেদের এই বলে সান্ত্বনা দিতে হবে যে, এখানে অবশ্যই আমার জন্য কোনো না কোনো অর্জন আছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের পাপগুলো মোচন করে দেবেন। আল্লাহ বলেন, إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ [সুরা ইনশিরাহ : ৬]
যখন আমরা উদ্বিগ্নতায় ভুগি তখন ঘুমোতে পারি না, হতাশাগ্রস্ত থাকি। আল্লাহর দিকে ফিরুন, তার ওপর ভরসা রাখুন। আপনার গুনাহ মুছে যাবে। আখিরাতের কঠিন দিনে আপনাকে টেনশন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করবে। এই দুনিয়ার কষ্ট সহ্য করা যায়, এক সময় বিপদ কেটেও যায়। কিন্তু আখিরাতের হতাশা অসহনীয় ও চিরস্থায়ী।
আখিরাতের চিন্তায় দুনিয়াবি পেরেশানি দূর হয়
মানসিক চাপ ও দুঃখ মোকাবিলার তৃতীয় পদ্ধতি এসেছে সুনানু মাজাহ-তে বর্ণিত একটি হাদিসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে তার সকল চিন্তা একটি বিষয়ের ওপরই সীমাবদ্ধ রাখে (অর্থাৎ খালি আখিরাত নিয়ে চিন্তিত থাকে) তাহলে আল্লাহ তার দুনিয়াবি সকল পেরেশানি দূর করে দেবেন।”
হাদিসটা একদম স্পষ্ট। আপনি যখন দুনিয়ার দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতার কথা বাদ দিয়ে আখিরাতকে ভাবনার মূল কেন্দ্রে রাখবেন (যেমন, আমি কীভাবে আল্লাহকে আমার কর্মের জবাব দিব, কীভাবে আল্লাহর কাছে আমার অবাধ্যতার জবাব দিব ইত্যাদি) তখন আল্লাহও আপনার দুনিয়ার জীবনের সকল দুশ্চিন্তার ভার নিয়ে নেবেন। তাই টাকা-পয়সা, ব্যবসার ধ্বস, সন্তান না হওয়া, দাম্পত্য সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করবেন না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, যে নিজেকে এই দুনিয়ার জালে জড়িয়ে ফেলবে এবং আখিরাতকে ভাবনায় স্থান দিবে না, সে তার জীবন কীভাবে শেষ করল তাতে আল্লাহর যায় আসে না।
অর্থাৎ আল্লাহ এই বান্দাকে পরিত্যাগ করবেন কারণ সে আল্লাহকে পরিত্যাগ করেছে। বিষয়টা আসলে গুরত্ব দেওয়ার মধ্যে। আখিরাতকে গুরত্ব দিলেই কেবল আখিরাত অর্জন করতে পারবেন আপনি। তাই আখিরাতের দুশ্চিন্তার কথা ভাবুন, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে অতিরিক্ত ভাববেন না।
অন্যের দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করা
নিজের উদ্বিগ্নতা কমানোর আরেকটি গুরত্বপূর্ণ পন্থা হল অন্যের উদ্বিগ্নতা, দুশ্চিন্তা দূর করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের দুশ্চিন্তা দূর করে আল্লাহ আখিরাতে তার দুশ্চিন্তা ও দুর্দশা দূর করবেন। যে তার ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিবসে তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন। যে তার ভাইয়ের ঋণ মওকুফ করে দিবে, আল্লাহ তার অক্ষমতা দূর করে দিবেন।”
এই কাজগুলো করা কঠিন হলেও এখানে অর্জন করার বিষয়টাও অনেক বড়। যখন আপনার মনে দুশ্চিন্তার মেঘ এসে ভর করে, যখন সেটাকে কোনোমতেই দূরে সরাতে পারছেন না, তখন অন্যের দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণা দূর করার চেষ্টা করুন। অন্যের জন্য নিজেকে কুরবানি করুন, তার মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলুন। আপনি নিশ্চিতভাবেই নিজের দুরবস্থা থেকে মুক্তি পাবেন ইনশাআল্লাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তার বান্দাকে ততক্ষণ সাহায্য করতে থাকবেন যতক্ষণ সে অন্যকে সাহায্য করে।”
নিজের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল, দুর্দশাগ্রস্ত কাউকে খুঁজে বের করা এবং তাকে দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করা। এর মাধ্যমে আল্লাহর নিয়ামতের কদরও করা যায়। যে, আল্লাহ আপনাকে অমুক ব্যক্তির মতো পরীক্ষায় ফেলেননি। আপনি নিজে পরীক্ষার সম্মুখীন হলেও যখন শোনেন যে অন্যরা আপনার চেয়েও বড় পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন আপনি আল্লাহকে ধন্যবাদ দেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করেন। আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ এর বিনিময়ে অনেক কিছু দিবেন আপনাকে, ইনশাআল্লাহ।
রাসুল (সা.) এর ওপর দরূদ পাঠ
নিজের উদ্বিগ্নতা কমানোর পঞ্চম পন্থা হল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর দুরুদ পাঠ করা। উবাই ইবনু কাব রা. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি আপনার প্রতি কত বেশী দুরুদ পড়ব? আমি কি আমার জিকিরের অর্ধেক সময় বা এক-তৃতীয়াংশ সময় আপনার প্রতি দুরুদ পাঠ করব?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জবাব দেন, “তুমি যদি পুরো সময় ধরে আমার ওপর দুরুদ পাঠ কর, তোমার সব দুশ্চিন্তা দূরীভূত হয়ে যাবে।”
মানসিক চাপের সময়, অথবা সময়টা যখন বেশ কঠিন, তখন আপনার জিহ্বাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের জিকিরে সিক্ত রাখুন। আপনার হৃদয় প্রশান্ত হবে। আপনি নির্ভাবনায় থাকতে পারবেন, স্বস্তি হৃদয়ে এসে ভর করবে। কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে বান্দা আমার প্রতি দুরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার দশগুণ সেই বান্দাকে ফেরত দেবেন।” দুশ্চিন্তা মোকাবিলার এই তালিকা অনিঃশেষ। কিন্তু আজ আমি এখানেই থেমে যাচ্ছি। মহান আল্লাহ আমাদের ইবাদতগুলোকে কবুল করে নিন। আমাদের দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনাগুলোকে তিনি দূর করে দিন। আমিন। ইয়া রাব্বুল আলামিন।
GIPHY App Key not set. Please check settings