বিবাহ একটি মুসলিম জীবনের অন্যতম ভিত্তি। তবে বৈবাহিক জীবনে সমস্যায় পড়েননি এমন ঘটনা বিরল। আপনিও যদি আপনার বৈবাহিক জীবনে নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন তাহলে তার সমাধান খুজতে আমার এই লেখা। এখানে ইসলামের আলোকে বৈবাহিক সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করবো যা অনেক মুসলিম দম্পতিদের কাজে আসবে।
কিছু বৈবাহিক সমস্যা ও ইসলামের আলোকে সমাধান
১। যোগাযোগের সমস্যা
দাম্পত্য জীবনে যোগাযোগের সমস্যা নিশ্চিত ভাবেই একটি বড় সমস্যা। ভাবছেন এক ছাদের নিচে থেকে যোগাযোগের সমস্যা কেন হবে? এখানে আসোলে যোগাযোগের সমস্যা বলতে অনুভূতি প্রকাশের সমস্যাকে বোঝানো হয়েছে। আপনি যখন অনুভূতি প্রকাশের জন্য আলোচনা করবেন তখন দোষারোপ করে কথা বলা এড়িয়ে চলুন। যেমন “তুমি স্বামী হিসেবে খুবই অলস” না বলে “তোমাকে ছাড়া কোন কাজ একা করতে আমার একদম ভালো লাগে না” এভাবে বলুন। অনেক দম্পতিই এভাবে ছোট একটা বিষয়কে নিজেদের মধ্যে বড় করে ফেলে।
২। স্বামী-স্ত্রী এবং শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যে সম্পর্ক
পরিবারের অন্য সদস্য বিশেষ করে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এমন বহু উদাহরন পাওয়া যাবে যেখানে স্বামী-স্ত্রী দ্বন্দ এমনকি তাদের ডিভোর্সের পিছনের কারন খুজলে পাওয়া যাবে যে, স্ত্রী হয়ত তার শুশুর-শাশুড়িকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে সে নিজের অগোচরে বা জেনে বুঝে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে যে অনাকাঙ্খিত আচরন প্রকাশ করেছে তা তার স্বামী কখনও স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। এবং একটা সময় এই সমস্যা প্রকট রূপ নিতে পারে। একইভাবে স্বামীও তার শশুড়-শাশুড়িকে নিয়ে অনাকাঙ্খিত আচরন করছে কিনা তার উপর পরিবারের শান্তি বা সংগীর সাথে মানসিক লেনদেনের বিষয়টি নির্ভর করে। তবে শ্বশুর-শাশুড়িদেরও উচিত স্বামী-স্ত্রীর সকল খুঁটিনাটি বিষয়ে নাক গলানো থেকে বিরত থাকা।
বৈবাহিক সম্পর্ক শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষার নয় বরং হৃদয় ও আত্মার মেলবন্ধন। যদিও ইসলামী শরিয়তে স্ত্রীর জন্য তার স্বামী ছাড়া অন্য কারও আনুগত্য করাকে ফরজ করা হয়নি। এটি ঐচ্ছিক বিষয়। তবে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা নেকীর কাজ তাতে কোন সন্দেহ নাই।
৩। আর্থিক মতবিরোধ
আপনার স্ত্রীর সাথে যদি প্রায়ই অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করুন। আপনার স্ত্রী এবং আপনি একে অপরের প্রতিপক্ষ নন, বরং উভয়ে মিলে এক দল হয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিন। অর্থনৈতিক দিক থেকে দম্পতিদের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা একান্ত জরুরি। ইসলাম স্ত্রী ও সন্তানের ভরনপোষনের দায়িত্ব স্বামীর উপর অর্পন করেছেন আর স্ত্রীকে স্বামীর উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করার নির্দেশ করেছে। এই কারনে স্ত্রীর সংগে অর্থনৈতিক বিবাদে না জড়িয়ে পরামর্শ করে চলতে হবে।
৪। ধর্মীয় আলোচনা ও শরিয়াহ ভিত্তিক সমাধান
দাম্পত্য জীবনে সংগীর সাথে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হতে পারে। তবে বিষয়গুলো নিয়ে মতভেদের কোন সুযোগ নেই। কারো ভিতর কোন ভুল ধারনা থাকলে কোরআন ও হাদিস অনুসন্ধান করে শুধরে নেয়ার বিষয়ে কোন অবহেলা করা যাবে না। অথবা কোন আলেমের সাথে আলোচনা করে বিষয়টির সমাধান করা উচিত। ধর্মভিত্তিক আলোচনা অথবা সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার শরীয়া ভিত্তিক সমাধান নিয়ে বর্তমানে অসংখ্য ভিডিও অনলাইনে পাওয়া যায় যেখানে বুজুর্গ আলেমগন আলোচনা করে থাকেন। প্রয়োজনে একই বিষয়ের একাধিক আলেমের ভিডিও দেখলে সঠিক সমাধান পাওয়া যায়। ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রেও সংগীর সাথে কিছু ভিন্ন অভিজ্ঞতা লক্ষ্য করা যেতে পারে। যেমন স্ত্রী হয়ত প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য কোরআন তেলাওয়াত করতে অভ্যস্ত কিন্তু স্বামী এই আমলটির প্রতি অভ্যস্ত না এবং স্ত্রীকেও ঠিক সেভাবে উৎসাহ দেয় না। একই বিষয় স্বামীর ক্ষেত্রেও হতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উভয়কে নমনীয় হওয়া উচিত।
৫। সংস্কৃতিগত পার্থক্য
আপনারা যদি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির হয়ে থাকেন তাহলে এই পার্থক্য বেশি দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশেও জেলাভিত্তিক ভিন্ন সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়। যার কারনে বিয়ের পর ২ পরিবারে ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, এই বৈষম্য কেবল ভৌগলিক, কারন ইসলাম সংস্কৃতির মধ্যে বৈষম্য করে না। তাই নিজেদের মধ্যে এই বৈষম্যকে সংঘর্ষে রুপান্তরিত হতে দেয়া যাবে না। তাই একে অপরের কাছে কি প্রত্যাশা করছেন তা নিজেদের মধ্যে পরিস্কার করে আলোচনা করে নিন।
৬। অন্তরঙ্গতা ও যৌন সম্পর্ক
বৈবাহিক জীবনে যৌনতাকে অগ্রাধিকার দিন। আপনার যৌন জীবনকে আনন্দদায়ক করার ব্যাপারে মনোযোগী হোন। ইসলাম যৌন মিলনের আগে ফোরপ্লে করার পরামর্শ দেয়। একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে: “যখন তোমাদের কেউ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, তখন সে যেন তার কাছে পাখির মতো না যায়; পরিবর্তে, তিনি ধীর এবং বিলম্বিত হওয়া উচিত।” [ওয়াসাইল উল-শিয়া, ১৪:৪০]। যৌনতার বিষয়ে তাড়াহুড়া না করে আপনি পর্যাপ্ত সময় নিন, এবং একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করুন।
৭। ক্ষমাশীল মানসিকতা
আমরা কেউই নিখুঁত নই, আমরা সবাই ভুল করি। আপনার স্ত্রী অথবা স্বামী যদি এমন কোন ভুল করে বসেন যা আপনার মনে আঘাত দিয়েছে তাহলে তা নিয়ে সরাসরি সঙ্গীর সাথে কথা বলুন। সঙ্গীকে তার ভুল বোঝার সময় দিন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে ক্ষমা করুন। পবিত্র কুরআনে লেখা আছে: “তারা ক্ষমা করুক এবং ক্ষমা করুক। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” [সূরা আন-নূর, ২৪:২২]। একজন ভাল মুসলিম হওয়ার অর্থ হল ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা, এমনকি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও।
পরিশেষে, বৈবাহিক জীবনে আরো নানারকমের সমস্যার মধ্যে পারিবারিক কলহ অন্যতম। ছোট খাট ভুল ত্রুটিতে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, কঠিন কথায় তিরস্কার করা ইত্যাদিও দাম্পত্যকে যন্ত্রনাদায়ক করে তুলতে পারে। আশাকরি উপরে আলোচিত ইসলামের আলোকে বৈবাহিক সমস্যার সমাধানগুলো আপনাদের নিজেদের জীবনকে সুন্দর ও বরকতময় করতে সাহায্য করবে।
GIPHY App Key not set. Please check settings