in

LoveLove

পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতি, করণীয় ও বর্জনীয়

রমজান মাসের প্রস্তুতি

ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, সাওম বা রোজা তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ। প্রতিবছর রমজান মাসে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোটি কোটি মুসলিম উম্মাহ যাবতীয় পাপাচরণ থেকে বিরত থাকার প্রতিরূপ হিসাবে পানাহার থেকেও বিরত থাকেন।

তারপর আসে আমাদের আকাঙ্খিত ঈদ উৎসব। তবে এই সাওম পালন কিন্তু শুধু সেহরি খাওয়া আর পুরো দিন না খেয়ে থাকা এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ না। বরং এর মাহাত্ম্য এতটাই বেশি যে আমাদের উচিত পবিত্র রমজান মাসে সাওম পালনের উদ্দেশ্যে আলাদা করে প্রস্তুতি নেয়া।

রমজানের পূর্ববর্তী মাস হলো শাবান মাস। পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতি নেয়ার সবচেয়ে ভালো সময় এই মাস থেকেই শুরু। শাবান চন্দ্রমাসের মধ্যে অন্যতম একটি মাস যাতে রয়েছে লাইলাতুল বরাত নামক অত্যন্ত বরকতময় রাত, একে শবে বরাতও বলা হয়। এই রাত হলো মাহে রমজানের আগমনী বার্তা। শাবান মাসপবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসাবে গণ্য করা হয়।

কী প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে জেনে নিই চলুন-

. ইবাদতবন্দেগী

রাসূলুল্লাহ (সা) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি বেশি নফল রোজা, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত ও নামাজ আদায় করতেন। আমরাও এভাবেই রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করব।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সা) কখনো নফল রোজা রাখতে শুরু করলে আমরা বলাবলি করতাম, তিনি বিরতি দেবেন না। আর রোজার বিরতি দিলে আমরা বলতাম যে তিনি মনে হয় এখন আর নফল রোজা রাখবেন না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করতে দেখিনি। কিন্তু শাবান মাসে তিনি বেশি বেশি নফল রোজা রেখেছেন” (মুসলিম)।

অন্য একটি হাদিস হতে পাই,“শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে রাসূলুল্লাহ (সা) এত অধিকহারে নফল রোজা আদায় করতেন না।” (বুখারি)।

তাই আমরা এই মাসে বেশি বেশি করে তাহাজ্জুদ পড়ব, নফল রোজা রাখব। এতে শুরু থেকেই আমাদের রোজা রাখায় কোনো কষ্ট হবে না। বেশি বেশি কুরআন তিলওয়াত করব যাতে অন্তর পবিত্র হয়। আল্লাহর কালামের তাসবিহ পাঠ করব।

একজন মুসলিম হিসাবে রবের নিকট প্রার্থনা করব যেন আল্লাহ তাআলা আমাদের শারীরিকভাবে সুস্থ রেখে, উত্তম উদ্দেশ্যের সাথে রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করেন, তিনি যেন আমাদের নেক আমল কবুল করেন।

. তওবা করা

তওবা করা একটি ওয়াজিব কাজ। যেহেতু আমরা সাওম পালন করতে চাচ্ছি তাই আমাদের যথাসম্ভব নিজেদের মানসিকতা পবিত্র করে নেয়া জরুরি। আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো গুণাহ আছে। তাই সেগুলো থেকে দ্রুত তওবা করে নেয়া উচিত, যাতে আমরা পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে রমজান মাসে আল্লাহর সমীপে ইবাদত করতে পারি।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আর হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ্‌র কাছে তওবা কর, যাতে করে সফলকাম হতে পার” [২৪ আন-নূর : ৩১] অর্থাৎ সাওমে সফল হতে হলেও আমাদের তওবা করতেই হবে।

রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ   رواه مسلم ( 2702 )

“হে মানবেরা, আপনারা আল্লাহর কাছে তওবা করুন। আমি প্রতিদিন তাঁর কাছে ১০০ বার তওবা করি।”

তাই আমরা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে তওবা করে পবিত্র রমজান মাসের জন্য সর্বাত্মক পবিত্র মনে প্রস্তুতি নেব।

. সুস্থ থাকা

আপনি ইবাদত করতে পারবেন, সালাত আদায় করতে পারবেন, সাওম পালন করতে পারবেন- সবই আপনার পক্ষে সম্ভব যদি আপনি অসুস্থ না থাকেন। সুস্থতা আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে হলে প্রথমে নিজেকে সক্ষম করে তুলুন। শরীরের যত্ন নিন, নিয়মিত গোসল, ওযু করে পাকপবিত্র থাকবেন, হালাল খাদ্য খাবেন, তাহলেই মনযোগ সহকারে শুধু রমজান মাস কেন, প্রতিটি মুহুর্ত আপনি আল্লাহর কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার শক্তি পাবেন।

. রমজানের আগমনে খুশি হওয়া

পবিত্র রমজান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি সত্যিই আমাদের জন্য এক অন্যতম নিয়ামত। রমজান মাস হলো কুরআন এর মাস। এ মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করা হয় পৃথিবীতে। তাই এ মাসের আগমনে মনে খুশি ও আনন্দ অনুভব করা আমাদের কর্তব্য। 

আমরা পরিবারের সদস্যদের রমজানের আগমনী শোনাবো। তাদের উৎসাহিত করব রোজা রাখার জন্য। পরিবারের যেসব ছোট সদস্য আছে তাদের কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কাহিনী শোনাব। মনের খুশিতে রমজানের প্রস্তুতি নেব।

. খাদ্যাভ্যাস

শাবান মাস থেকেই আমরা পরিমিত খাব। নফল রোজা রাখা শুরু করব। হালাল খাদ্য খাওয়ার জন্য সবাইকে প্রেরণা দেব। হাদিস থেকে কুরআন এর ব্যাখ্যা দিয়ে শিখিয়ে দেব কী কী খাবার খেতে হবে।

. রোজার নিয়মকানুন জেনে নেয়া

প্রতিটি ইবাদতেরই কিছু নিয়মকানুন আছে যেগুলো অনুসরণ না করলে তা কবুল হয় না। রোজাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমরা যেন রমজান মাসের প্রতিটি দিন সফলভাবে সঠিক নিয়মে ইবাদত করতে পারি অর্থাৎ সাওম পালন করতে পারি, সেজন্য আগে থেকেই রোজার বিধিনিষেধ জেনে নেব। যাতে তখন ভুল হয়ে আমাদের রোজা কবুল না হওয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি না হয়।

আমরা এর জন্য বিভিন্ন হাদিস পড়তে পারি। গুণী আলেমদের মাসআলা জেনে নিতে পারি। যেমন-সফরে বা ভ্রমণে থাকা অবস্থায়ও যদি কোনো ব্যক্তি রোজা পালন করে, তবে সেটাই উত্তম। আর বেশি কষ্ট হলে বা ইচ্ছা করলে রোজা ছাড়তে পারবেন। তবে এই রোজা পরে সুবিধামতো নিকটতম সময়ে কাজা আদায় করে নিতেই হবে। 

. রোজায় পূর্ণ মনযোগ দেয়া

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বেশ কিছু কাজ থাকে যেগুলো নিত্যদিন প্রচুর ব্যস্ততা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী শ্রেণির মানুষেরা এগুলো বেশি মোকাবিলা করেন। 

এমতাবস্থায় রোজার প্রতি পূর্ণ মনযোগ না থাকায় আপনি কোনো ভুল করে ফেলতে পারেন। তাই রমজান মাসের পূর্বেই কিছু কাজ এগিয়ে রাখবেন যাতে উক্ত মাসে রোজার দিকেই মনযোগ বেশি যায়। বৈষয়িক বিষয়গুলোর কাজকর্ম আগেভাগে শেষ করে রাখাই ভালো। 

. আর্থিক প্রস্তুতি

রমজান মাসে আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। যেমন ভালো ইফতার সামগ্রী, ফলমূল, দানখয়রাত, মাহফিল, পোশাক (ঈদের জন্য) ইত্যাদি ছাড়াও সাংসারিক অন্যান্য খরচ তো আছেই। সামনে ঈদও রয়েছে। 

পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে আগে থেকেই কিছু অর্থ জমিয়ে রাখার চেষ্টা করুন যাতে ঈদের আনন্দে তারা সকলে উদ্ভাসিত হয়ে মহান আল্লাহর পথে অগ্রসর হয়।

. রোজাদারদের প্রতি কর্তব্য

এলাকায় রোজাদারদের উপযোগী মসজিদ এর পরিবেশ নিশ্চিত করা যেতে পারে। মুসল্লিরা যাতে মসজিদে এসে কোনো রকম ভোগান্তি যেমন ওযুর পানি স্বল্পতাতে না ভোগে আমরা খেয়াল রাখব।

১০. সহীহ ভাবে কোরআন তিলাওয়াত

পবিত্র রমজান মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ায় এ মাসে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করার অনেক ফজিলত রয়েছে। তবে কোরআন তেলাওয়াত করতে হয় তারতিলের সাথে এবং বিশুদ্ধভাবে। 

এজন্য রমজানের আগেই আপনার কোরআন তেলাওয়াত বা শুদ্ধ আছে কিনা তা বিজ্ঞ কোন আলেমের কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত। যাতে পবিত্র রমজান মাসে আপনি শুদ্ধভাবে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন।

রমজানে যেসব অভ্যাস পরিহার করতে হবে

১. অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকা

বেশি কথা বলা বা অপ্রয়োজনীয় কথা বলা কোন সময়ই ভালো গুণ নয়। আর মিথ্যা কথা বলা তো সব পাপের জননী। তাই রমজান মাসে সদালাপের চর্চা করা বা কম কথা বলা এবং সত্য কথা বলার ভালো গুণ আয়ত্ব করার বেশি বেশি করে চেষ্টা করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কত রোজা পালনকারী এমন আছে, (রোজা অবস্থায় অশ্লীল কথা ও কর্ম থেকে বিরত না থাকার ফলে) ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া রোজা থেকে সে আর কিছু লাভ করতে পারে না। অনুরূপ অনেক রাত জাগরণকারী এমন আছে যে তার রাত্রিজাগরণ থেকে জেগে থাকার কষ্ট ছাড়া আর কিছু পায় না।” (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯০)

রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে রোজা রেখেছে অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি, তার এই কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। (বুখারি: ১৯০৩)

২. গীবত থেকে বিরত থাকা

গীবত আমল ধ্বংসের নিরব ঘাতক। এটি বেশি কথা বলার সাথেও সম্পর্কিত। বেশি কথা বললে মিথ্যা বলা এবং গীবত করার প্রবণতা বেশি দেখা দিতে পারে। গীবতের কারণে কখন যে আপনার আমল ধ্বংস হয়ে যাবে তা বুঝতেই পারবেন না। গীবত জিনার চেয়েও জঘন্যতম গুনাহ। তাই গীবত পরিহার উচিত।

৩. দৃষ্টির হেফাজত করা

যেকোন খারাপ কাজে দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকা উচিত। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দৃষ্টি ইবলিসের তীরগুলোর মধ্যে একটি। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ভয়ে এটা হতে বেঁচে চলবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন ঈমানী নূর দান করবেন যার মিষ্টতা ও স্বাদ সে তার দিলের মধ্যে অনুভব করবে।

৪. খাবার গ্রহণে সতর্কতা

সেহরি এবং ইফতারের খাবারসহ রোমজান মাসে সব ধরনের খাবার গ্রহণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এ সময় যেকোন সন্দেহযুক্ত খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত। যে ব্যক্তি রোজা রেখে হারাম মাল দিয়ে ইফতার করে, তার অবস্থা ওই ব্যক্তির মতো যে কোনো রোগের জন্য ওষুধ ব্যবহার করে, কিন্তু তার সঙ্গে সামান্য বিষও মিশিয়ে নেয়। ফলে ওষুধ তার রোগের জন্য উপকারী হলেও পাশাপাশি বিষ তাকে ধ্বংস করে দেবে।

অতি ভোজন ও সময়মত না খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করতে হবে। খাদ্যের অপচয় ও কৃপণতা রোধ করতে হবে।

শ্রদ্ধেয় দ্বীনি ভাই ও বোন পবিত্র রমজান মাসের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে আবেদন পেশ করুন যাতে আমাদের সকলের সাওম আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন, আমিন।

What do you think?

Written by নুসরাত জাহান

পেশায় একজন নার্স হলেও ইসলামিক বিষয় নিয়ে পড়তে ও লিখতে ভালো লাগে। আমার লেখা থেকে যদি কেউ বিন্দুমাত্র উপকৃত হয় তবেই আমার প্রশান্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

Humidifier Buy in Bangladesh

হিউমিডিফায়ার কি এবং এর উপকারিতা

খেজুরের-নাম-দাম-মান

খেজুরের খোঁজঃ দাম ও মানের বিস্তারিত