দুটি চঞ্চল বাচ্চার মা সারমিন। সারাদিন ঘরময় ছুটোছুটি আর হুটোপুটি চলে ভাইবোনের মধ্যে। খেতে বসেও করে নানান যন্ত্রনা। বাচ্চাদের চঞ্চলতা কমানোর জন্য এবং কিছুটা সময় শান্ত রাখার জন্য সারমিন প্রায় টিভি অথবা মোবাইল বাচ্চাদের হাতে দিয়ে দেয়। এভাবে সন্তানরা অতিমাত্রায় স্ক্রিনে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের স্বাভবিক বৃদ্ধি ব্যহত হচ্ছে। এমতবস্তায় অভিভাবক হিসেবে তার করনীয় কী এই বিষয়ে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছেন। চলুন দেখি আপনার সন্তান অতিমাত্রায় স্ক্রিনে আসক্ত হলে কিভাবে তা দূর করবেন তা নিয়ে আলোচনা করি।
স্ক্রিন আসক্তি বলতে কি বোঝায়?
১ম পর্বে স্ক্রিন টাইম সংক্রান্ত প্রাথমিক ধারনা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় কোন বিষয় বা বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়া এবং সে বিষয় বস্তুতে আনন্দ উপভোগ করা এবং একই সাথে ঐ বস্তুর অনুপস্থিতিতে অসুস্থ বোধ করাকে আসক্তি বলে। যেকোন ডিভাইস যেমন মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ ইত্যাদির স্ক্রিনের প্রতি আসক্তিকেই স্ক্রিন আসক্তি হিসেবে ধরা হয়। এই আসক্তি দেখা দিলে সন্তানদের মধ্যে পরিবারের অন্যান্য সদস্যাদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। শিশুদের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ জিনিসে আসক্তি আরো মারাত্বক হতে পারে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়, বিকাশ হয় না ঠিকমত, সমবয়সী অন্যান্য বাচ্চাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, তাদের পরবর্তী জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে এই আসক্তি।
আপনার সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। এখন আপনার কাছে যদি তার জন্য সময় না থাকে তবে ভবিষ্যতে তার কাছেও আপনার জন্য সময় থাকবে না। আপনার সন্তানের সাথে কোয়ালিটি সময় পার করুন। তার সাথে খেলুন, গল্প করুন, স্কুলে সে সারাদিন কি করেছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করুন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তার পছন্দের খাবার রান্না করুন, তাকে নিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার বাইরে যান। স্ক্রিনে শিশুরা একদিনে যেমন আসক্ত হয় না তেমন এক দিনে এর থেকে মুক্ত করাও যায় না। ধীরে ধীরে ধৈর্য ধরে সন্তানকে এর থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
অভিভাবক হিসেবে করনীয় কী
সন্তানকে স্ক্রিনে আসক্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে সবচেয়ে সহজ উপায় হল যে কোন স্ক্রিন থেকে দূরে রাখা। তবে এই উপায় আসক্ত হওয়া থেকে বাঁচাবে কিন্তু যে শিশু ইতোমধ্যে আসক্ত হয়ে গেছে তাদের জন্য অভিভাবক হিসেবে আপনার করনীয় কি চলুন তা নিয়ে আলোচনা করি।
১। বিকল্প কোন কাজে উৎসাহিত করে তুলুন
আপনার সন্তান দীর্ঘ সময় টিভি, মোবাইল বা ট্যাব দেখে সময় কাটায়। তাকে এইসব কিছুর পরিবর্তে ভিন্ন কিছুতে মনোযোগ দিতে দিন। সে যা করতে ভালোবাসে যেমন, ছবি আঁকা, নাচ করা, ক্র্যাফটিং বা বিশেষ কোন খেলা যা সে খেলতে ভালোবাসে এমন কাজে উৎসাহিত করুন। তার বিশেষ পছন্দের বিষয়গুলোকে তার সামনে আনুন। শিশু যদি ছবি আঁকতে ভালোবাসে তবে তাকে বিভিন্ন রকমের রঙ পেন্সিল, বোর্ড, আর্ট পেপার, তুলি ইত্যাদি কিনে দিন। খেলতে ভালবাসলে খেলাধুলার উপকরণ কিনে দিন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটেও ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন। মোট কথা তাকে বিকল্প কিছুর সাথে অভ্যস্ত করে তুলুন।
২। নিজে স্ক্রিনে সময় কাটানো বন্ধ করুন
অনেক সময় সন্তানদের তো স্ক্রিন থেকে আমরা দূরে থাকতে বলি কিন্তু আমরা নিজেরাই স্ক্রিনে অনেক বেশী সময় কাটিয়ে ফেলি। অফিস থেকে ফিরেই হয়ত মোবাইল নিয়ে বসে পড়ি। অথবা সন্তানকে পড়তে বসিয়ে নিজে মোবাইল বা ট্যাবে সময় কাটাই। অনেক বেশী টিভি দেখি। কাজ ছাড়াও ল্যাপটপে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করি। আমাদের বড়দের এইসব বদ অভ্যাসের কারনে আমাদের সন্তানেরাও স্ক্রিনের প্রতি অতি মাত্রায় আগ্রহী হয়ে পড়ে। তাই প্রয়োজন ছাড়া আপনি নিজেও যে কোন স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন।
৩। স্ক্রিনের জন্য সময় বরাদ্দ করে দিন
যে শিশুটি ইতোমধ্যে স্ক্রিনে আসক্ত তাকে হঠাৎ করে স্ক্রিন থেকে সম্পূর্নরূপে দূরে সরিয়ে রাখলে সে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই একেবারে বন্ধ না করে দিয়ে সীমিত করে দিন। মোবাইল বা ট্যাবের জন্য সময় নির্ধারন করে দিতে পারেন। টিভিতে নির্ধারিত কোন অনুষ্ঠান দেখার অনুমতি দিতে পারেন। আবার সঠিক সময়ে স্কুলের পড়া শেষ করলে বা হোম ওয়ার্ক করলে কিছু সময়ের জন্য টিভি বা মোবাইল দেখতে পারবে এমন নিয়মও করে দিতে পারেন। এতে অকারনে সারা সময় স্ক্রিনে আবদ্ধ থাকাটা কিছুটা হলেও কমে আসবে।
৪। সন্তানের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
আপনার সন্তানকে শুধু পাঠ্য পুস্তক না, এর বাইরেও বয়স উপযোগী বিভিন্ন গল্প কবিতার বই এর সাথে সময় কাটানোর সুযোগ দিন। বই এর সাথে একবার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে গেলে এমনিতেই স্ক্রিনের নেশা অনেকটায় কেটে যাবে। উপরুন্তু আপনার সন্তানের মানসিক বিকাশ ভালো হবে। জ্ঞান বাড়ার পাশাপাশি ভালো চিন্তা করা, ভাল মন্দের পার্থক্য করতে শেখা, ভাষাগতভাবে সমৃদ্ধ হওয়া সবই বই পড়ার মাধ্যমে সম্ভব।
আপনি নিজেও সন্তানের সাথে বই নিয়ে আলোচনা করুন। গল্পের বইএর বিভিন্ন চরিত্রগুলো বুঝতে তাকে সাহায্য করুন। তার বয়সের সাথে মানানসই বই খুঁজে বের করতে সাহায্য করুন। এতে সে নিজেও বই এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
৫। সন্তানকে সময় দিন
সর্বোপরি আপনার সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিন। এখন আপনার কাছে যদি তার জন্য সময় না থাকে তবে ভবিষ্যতে তার কাছেও আপনার জন্য সময় থাকবে না। আপনার সন্তানের সাথে কোয়ালিটি সময় পার করুন। তার সাথে খেলুন, গল্প করুন, স্কুলে সে সারাদিন কি করেছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করুন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তার পছন্দের খাবার রান্না করুন, তাকে নিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার বাইরে যান। সন্তানকে বোঝান যে আপনি যত ব্যস্তই থাকুন না কেন, সন্তান আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। স্ক্রিনে শিশুরা একদিনে যেমন আসক্ত হয় না তেমন এক দিনে এর থেকে মুক্ত করাও যায় না। ধীরে ধীরে ধৈর্য ধরে সন্তানকে এর থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। সন্তানকে স্ক্রিনের নেশা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য অভিভাবক হিসেবে আপনি কি করতে পারেন সে বিষয়ে আজকে কিছুটা আলোচনা করলাম, পরবর্তী পর্বে আমরা বাকিটা আলোচনা করবো। ততক্ষন পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।
GIPHY App Key not set. Please check settings