আমরা সবাই কখনো না কখনো এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। দীর্ঘ দিনের ক্লান্তি নিয়ে যখন সোফায় এলিয়ে পড়ি, তখন মনে মনে ভাবি একটা ভালো বই হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মগ্ন হওয়া যাক। বইটা খুলি, গল্পের জগতে ঢুকে পড়ার জন্যে উদগ্রীব থাকি, কিন্তু পড়তে গেলেই চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। মনোযোগ কমতে থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেই। এবার ঠিক টেরই পাই না যে কখন অর্থহীনভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে এক ঘণ্টা কেটে গেছে। প্রশ্ন হলো কেন এমনটা হয়?
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই সমস্যাটি খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। গবেষকরা দেখেছেন যে, যারা মাত্র দশ মিনিট ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করেন তাদের মস্তিষ্কের মনোযোগ অনেক কমে যায়। অন্যদিকে যারা একই সময়টুকু কোনো লেখা পড়েন [বই থেকে] তাদের মধ্যে মনোযোগ অনেক বেশি থাকে। মস্তিষ্কের স্ক্যানের ফলাফলে দেখা যায় যে, স্ক্রল করার সময় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের (মনোযোগ ও সমালোচনাধর্মী চিন্তার জন্য দায়ী মস্তিষ্কের এলাকা) কার্যক্ষমতা অনেক কমে যায়।
স্মার্টফোন এবং বইয়ের সাথে আমাদের মস্তিষ্কের প্রতিনিয়ত যে লড়াই দেখা যাচ্ছে তা ফুটে উঠেছে গবেষণায়।আসুন আমরা দেখি, কেন স্ক্রল করা খুব সহজ মনে হয়, কোনো এফোর্টই দেওয়া লাগে না কিন্তু বই পড়তে গেলেই মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। আর এর কারণে আমাদের ঘুম ও স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
১. সহজ স্ক্রলিং
সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করা খুব সহজ মনে হয়। পোস্টগুলো ছোট ছোট হয়। কালারফুল হয়। ছবি থাকে। তথ্যগুলো ছোট ছোট হওয়ায় ব্রেইনে প্রসেস করাও সহজ হয়। এই সব কিছু মিলে মস্তিষ্কে খুব কম চাপ লাগে।
অন্যদিকে, বই পড়ার সময় মস্তিষ্কে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। শব্দগুলো বুঝতে হয়। গল্পের ধারা ধরে রাখতে আর গল্পের মধ্যে কল্পনা করতে মস্তিষ্ককে অনেক বেশি খাটাতে হয়। এক চরিত্রের সাথে আরেক চরিত্রের সম্পর্ক মনে রাখতে হয়। সারা দিন পরিশ্রম করে আসার পর এই মানসিক পরিশ্রম ক্লান্তি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
২. সোশ্যাল মিডিয়ার ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন বনাম বইয়ের একটু দেরিতে পাওয়া আনন্দ
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং ফোনের অ্যাপগুলো আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের একটা রাসায়নিক তৈরি করে, যা আমাদেরকে ভালো লাগার অনুভূতি দেয়। প্রতিটা লাইক, কমেন্ট, বা মজার পোস্টের সাথে সাথে আমরা একটু আনন্দ পাই, আর এই আনন্দ পেতেই আমরা স্ক্রল করতে থাকি।
কিন্তু বই পড়ার আনন্দ একটু আলাদা। বই পড়ে জ্ঞান লাভ, গল্পের মজা, বা গল্পের চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া – এই সবকিছুই একটা আলাদা ধরণের আনন্দ দেয়। এই আনন্দ হয়তো সোশ্যাল মিডিয়ার মতো তাড়াতাড়ি আসে না, কিন্তু এটা আরও গভীর এবং স্থায়ী হয়।
৩. নীল আলোর সমস্যা
ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিন থেকে যে নীল আলো বের হয়, সেটা ঘুমের জন্য জরুরী একটা হরমোন তৈরি হতে দেয় না। এই হরমোনের নাম মেলাটোনিন। ফলে, ফোন নিয়ে ঘুমের আগে ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রল করলে ঘুমের চক্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু, হাতে নেওয়া বই পড়ার সময় এই নীল আলোর সমস্যা থাকে না। ফলে বই পড়তে গিয়ে অনেক সময় ঘুম চলে আসে। আর রাতে ঘুম না আসার সমস্যা থাকলে জটিল একটা বই নিয়ে বসে পড়ুন, চমৎকার ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করবে বইটা।
তাহলে কিভাবে ডিভাইসের প্রলোভনকে উপেক্ষা করে বইয়ে ডুবে থাকা যায়? আসুন দেখি কয়েকটা ফন্দিঃ
১. আপনার পছন্দের বই পড়ুন
যদি কোন বই পড়তে পড়তে আপনার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে, তাহলে হয়তো সেই বইটা আপনার জন্য নয়, অন্তত ক্লান্ত মনে পড়ার জন্য। আপনি বিভিন্ন ধরণের গল্প, বিভিন্ন ধাঁচের বই আর একেক লেখকের বই পড়ে দেখুন। এমন কিছু বই খুঁজুন যা আপনার কৌতূহল জাগাবে। একের পর এক পাতা উল্টাতে বাধ্য করবে।
২. টাইমার দিন
একটা ঘড়ি ১৫-২০ মিনিটের জন্য সেট করুন এবং সেই সময়টুকু মন দিয়ে শুধু বই পড়ায় মনোযোগ দিন। ছোট ছোট করে পড়লে বড় বইটাও কঠিন মনে হবে না।
৩. পড়ার জায়গা পালটান
সবসময় বাড়িতে বই পড়ার অভ্যাস, কিন্ত ঘুম চলে আসে? পড়ার জন্য একটা আরামদায়ক আর আলোযুক্ত জায়গা বেছে নিন। শুধু ঘুমের আগে না, দিনে বা অন্য কোনো সময়ে পার্কে বা ক্যাফেতে বসেও বই পড়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার মনে গেঁথে যাবে যে, ঘুমের আগে বিছানায় বই পড়া বাদেও বই পড়ার আরো সময় আছে।
৪. ই-রিডার ব্যবহার করুন
ই-রিডারে ফন্টের সাইজ আর পাতার আলো কমানো-বাড়ানো যায়, তাই এটা বই পড়ার জন্য আরামদায়ক। কিছু ই-রিডারে ফোনের মতো নীল আলোও কম থাকে। তবে, রাতে ই-রিডারে বই পড়লে ঘুমের সমস্যা হতে পারে, সেটা মাথায় রাখবেন।
৫. ফেসবুকে বা গুডরিডসে বইয়ের গ্রুপে যোগ দিন
অন্য পাঠকদের সাথে বই নিয়ে আলোচনা করলে বই পড়াটা আরও বেশি আনন্দদায়ক হয়, বইয়ের নতুন দৃষ্টিকোণ পাওয়া যায় এবং মজাও লাগে।
৬. অডিওবুক শুনুন
যদি হাতে নিয়ে বই পড়া কষ্টের মনে হয়, তাহলে অডিওবুক শোনা ভালো। অফিসে যাওয়া-আসা, কাজ করার সময়, এমনকি এক্সারসাইজ করার সময়ও অডিওবুক শোনা যায়।
৭. পুরস্কার দিন নিজেকে
বই পড়ার লক্ষ্য ঠিক করুন এবং সেই লক্ষ্য পূরণ করলে নিজেকে পুরস্কৃত করুন। একটা অধ্যায় শেষ করার পর, কিংবা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা পড়ার পরে, নিজেকে পুরষ্কৃত করুন। যেমন, পড়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলে একটা চকোলেট খান বা নিজেকে একটা বিরিয়ানি ট্রিট দিন। এতে পড়াশোনা আরও মজাদার লাগবে।
৮. অ্যাপ ব্যবহার করুন
আজকাল এমন অনেক অ্যাপ আছে যা বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য তৈরি। এই অ্যাপগুলোতে আপনি কতটা পড়লেন, পড়ার লক্ষ্য কী ঠিক করলেন, সেসব লেখা থাকে। আপনার পছন্দের বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন বইয়ের পরামর্শও দেয় এই অ্যাপগুলো।
৯. ছোট বই থেকে শুরু করুন, বড় বই পরে পড়ুন
একসাথে খুব মোটা বই পড়ার চেষ্টা করবেন না। ছোট গল্পের বই দিয়ে শুরু করুন। ধীরে ধীরে পড়ার অভ্যাস বাড়লে পরে আরও বড় বড় বই পড়তে পারবেন।
GIPHY App Key not set. Please check settings