ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে আসছি, আখলাক দু প্রকার। একটি হলো সচ্চরিত্র বা আখলাকে হামিদাহ, অন্যটি অসচ্চরিত্র বা আখলাকে যামিমাহ। এই আখলাকে যামিমাহ এর অন্তর্ভুক্ত একটি অন্যতম নেতিবাচক মানববৈশিষ্ট্য হলো রাগ বা ক্রোধ। রাগ বা ক্রোধের বশে আমরা প্রতিনিয়তই এমন কিছু কাজ করে চলেছি যা আমাদের জীবনের চলার পথের শান্তি নষ্ট করছে। সেই সাথে আমরা হারিয়ে ফেলছি নৈতিক মূল্যবোধ।
চলুন জেনে নেয়া যাক কুরআন এ আল্লাহ তায়ালা ক্রোধকে কী দৃষ্টিতে দেখেছেন,
الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَالضَّرَّآءِ وَالۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَالۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَاللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ۚ
বাংলা অনুবাদঃ “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষকে ক্ষমা করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪)।
অর্থাৎ আপনাকে আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে হলে যে গুণাবলী অর্জন করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ।
রাসুলুল্লাহ (স) একইভাবে আল্লাহ প্রদত্ত পথ অনুসরণ করে মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন ধৈর্যের সান্নিধ্যে থেকে রাগ নিবারণ করে আল্লাহ তায়ালার অনুগামী হওয়ার।
নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়ার অধিকার দান করবেন।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৬)।
তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছুতে নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৯)।
তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষকে ক্ষমা করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন।
আল্লাহর এসব অসংখ্য নেয়ামত ভোগ করার জন্য আমাদেরকে সচেষ্ট হতে হবে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কায়মনোবাক্যে তার দেয়া আদেশ উপদেশ মেনে চলার।
এখন প্রশ্ন হলো আপনি কী করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করবেন? ফিরে যাওয়া যাক রাসুল(স) এর জামানায়।
এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-কে বললেন, “আপনি আমাকে অসিয়ত করুন।” তিনি বললেন, ”তুমি রাগ করো না”। ওই ব্যক্তি কয়েকবার তা বললেন। নবীজি (সা.) প্রতিবারই বললেন, “রাগ করো না”। (বুখারি, খণ্ড: ৮, অধ্যায়: ৭৩, হাদিস: ১৩৭)। এই ঘটনা থেকে কি উপলব্ধি করতে পারছেন একজন মানুষ হিসাবে রাগ সংবরণ করা কতটা জরুরি?
‘যদি তোমাদের কেউ দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তবে তার উচিত বসে পড়া। যদি তার রাগ কমে যায়, তবে ভালো; নয়তো তার উচিত শুয়ে পড়া।’ (তিরমিজি), মহানবী (স) মূলত এ বক্তব্যের দ্বারা একজন রাগান্বিত মানুষের নিজের শুধু শারীরিক না মানসিক অবস্থারও ধাপে ধাপে পরিবর্তন নির্দেশ করেছেন।
শরীয়াহ মোতাবেক রাগ নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলী
- নবীজি (সা.) বলেন, ‘রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে; শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে আগুন থেকে, আর একমাত্র পানির মাধ্যমেই আগুন নেভানো সম্ভব। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তার উচিত অজু করা।’ (আবু দাউদ)। আপনি রাগান্বিত হলে যত দ্রুত সম্ভব তওবা পড়ে আল্লাহর কাছে এ গুণাহ হতে বাঁচার জন্য পানা চান এবং ওযু করে নিন।
- “আউযু বিল্লাহি মিনাশ্ শাইত্বনির রাজিম” অর্থাৎ, আমি বিতাড়িত শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।’ (মুসলিম, অধ্যায়: ৩২, হাদিস: ৬৩১৭)- নবীজি এই কালাম পাঠ করতে মুমিনদের উৎসাহিত করেছেন যাতে তারা আল্লাহর রহমতে দ্রুত ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।
- ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.) বর্ণনামতে, নবীজি (সা.) আমাদের আরও উপদেশ দিয়েছেন, ‘যদি তোমাদের কেউ রাগান্বিত হয়ে পড়ে, তবে তাকে নীরব থাকতে দাও।’ যদি কোনো ব্যক্তি শান্ত বা নীরব হওয়ার চেষ্টা করে, তবে এটা অবশ্যই তাকে মারামারি কিংবা কটু কথা বলায় বাধা প্রদান করবে। আমাদের সকলের উচিত হবে আমাদের প্রতিবেশী বা যে ই হোক তাকে শান্ত করার চেষ্টা করা ও তাকে সেই পরিবেশের সুযোগ করে দেয়া।
নবীজি (সা.) একবার সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কাকে তোমরা অধিক শক্তিশালী মনে করো?’ তাঁরা উত্তর দিলেন, ‘যে ব্যক্তি কুস্তিতে অন্যকে হারিয়ে দিতে পারে।’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘সে প্রকৃত বীর নয় যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়; বরং সে-ই প্রকৃত বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।’ (বুখারি: ৫৬৮৪)। আপনারা প্রত্যেকে উপরোক্ত ৩ টি উপায়ে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ এর চেষ্টা করবেন শরীয়াহ মোতাবেক।
সবশেষে জানাই মহান আল্লাহ পাকের বলা সুনির্দিষ্ট এক নির্দেশনা-
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তোমাদের যা দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগমাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের পালনকর্তার ওপর ভরসা করে। যারা বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধান্বিত হয়েও ক্ষমা করে।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত: ৩৬-৩৭)। সুতরাং মহান আল্লাহর সুশীতল স্নেহছায়াতলে আপনি নিজে এবং পরিবার সহ অবস্থান করতে আখলাকে হামিদাহ অভ্যাস করুন এবং ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যান। আল্লাহ হেদায়াত করুন সকলকে, আমিন। মহান আল্লাহ তাআ’লা আমাদের সবাইকে ইসলামিক শরিয়া অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবন যাপনকে সহজ করে দিন।আমিন।
GIPHY App Key not set. Please check settings